এখন থেকে প্রায় একষট্টি বছর আগে কোন এক শীতের বিকেলে অগ্রহায়নের শেষ দিনে, এক রোববারে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনীতে আমার জন্ম হয়। এমনিতেই ছোট দিন, তখন দিনেরও প্রায় শেষ, একটু আগেই আসরের নামাজীরা মাসজিদ থেকে ঘরে ফিরে গেছেন। ক্লান্ত সূর্য্টা দিগন্তে রক্তিমাভা ছড়িয়ে অস্ত যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে, পাখিরা ঘরে ফেরার। এমনি এক সময়ে আমি দিনের শেষ আলোটুকু ধরার জন্যই যেন পৃ্থিবীর বুকে ভূমিষ্ঠ হ’লাম। পুরো জীবনটাকে যদি একটা দিন হিসেবে ধরি, তবে বলা যায়, আমার জন্মের সময় যেমন পড়ন্ত বিকেল ছিলো, আজও এখন আমি যেন সেই পড়ন্ত বিকেলে উপনীত। কর্মময় জীবন শেষ করে অবসর জীবনে এসে সুযোগ হচ্ছে পিছু ফিরে তাকাবার। জীবনের নানা বাটে ঘাটে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধ দর্শনকে স্মরণ করে বিদগ্ধ পাঠককূলের সাথে আমার হৃদয়ের গভীর অনুভূতিগুলো শেয়ার করার মানসে কিছু লেখালেখি শুরু করেছি।
বাবার বদলীর কারণে আমরা ঢাকায় চলে এলে আমার স্কুলজীবন শুরু হয় ঢাকায়, সরাসরি তৃতীয় শ্রেণী থেকে। সে আমলে এটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু ছিলোনা। এর আগে বাসায় বসেই বাবা আর মায়ের তত্ত্বাবধানে বাংলা, ইংরেজী, অঙ্ক আর হস্তলিপি শিখেছিলাম। আর সরাসরি বাবার তত্ত্বাবধানে স্কুলে যাবার আগেই প্রথমে কায়দা, পরে আম্পারা আর তারপর পবিত্র ক্বোরান পাঠ শিখেছিলাম। তবে নামায পড়া শিখেছি আরো অনেক পরে। তখনকার চট্টগ্রামের স্মৃতির মধ্যে মনে পড়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইউব খানের চট্টগ্রাম সফর উপলক্ষে জাম্বরী মাঠের প্রস্তুতি। সারাদিন ধরে রোলার, গ্রেডার আর ক্যাটারপিলার চলার শব্দ আর পোড়া ডিজেল মবিলের ধোঁয়ার গন্ধ আজও নাকে লেগে আছে। আর মনে আছে ১৯৬০ সালের প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন, যার পরে পরেই আমরা চট্টগ্রাম ত্যাগ করে ঢাকায় চলে আসি।
দু’বছর পরে মতিঝিল সেন্ট্রাল গভর্ণমেন্ট উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম আর টিকেও গেলাম। স্কুলটাকে খুব ভালো লাগতো। আমি ভর্তি হবার পরে শুনি যে জনাব মঈন খান সাহেব (বিএনপি’র মন্ত্রী) ঐ স্কুল থেকেই ঢাকা বোর্ডে (কিংবা তৎকালীন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডে) প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। আমাদের স্কুলে ভালো টিফিন দেয়া হতো। ক্লাস ক্যাপ্টেনের তত্ত্বাবধানে তা বিতরণ করা হতো। বুড়া স্যার নামে একজন দীনিয়াত শিক্ষক ছিলেন, যিনি কথায় কথায় মাথায় আর কনুই এর হাড্ডিতে ডাস্টার এর বারি মারতেন। একজন বাংলা শিক্ষক ছিলেন যার কন্ঠস্বর খুব চমৎকার ছিলো। তার আসল নামে আমরা তেমন একটা ডাকতাম না বলে সে নামটা ভুলে গেছি, তবে তাকে আমরা টেলিভিশন স্যার নামে ডাকতাম, সেকথা মনে আছে।
স্কুলে বিরাট একটা খেলার মাঠ ছিলো এবং সেখানে নিয়মিত আন্তঃস্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। ফ্রী হ্যান্ড এক্সারসাইজের জন্যেও বেশ কিছু অবকাঠামো ছিলো। আমি নিজে কখনো খেলাধূলায় তেমন ভালো ছিলাম না, তবে প্রায় সব খেলাই ভালোবাসতাম, আগ্রহভরে দেখতাম আর তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে রাখতাম। আমার আব্বা আর বড়ভাইরাও ফুটবলের ভক্ত ছিলেন। ঢাকা লীগের শেষ পর্বের খেলাগুলো দেখার ব্যবস্থা তারাই করে দিতেন। আর ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব বনাম মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের মধ্যে খেলা হলে তো কোন কথাই নেই। তখন আবাহনী দলের জন্ম হয়নি। ভিক্টোরিয়া আর মোহামেডানই দুটো সেরা দল ছিল।
চলবে….
ঢাকা
০৩ জুলাই ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।